নিজস্ব সংবাদদাতা – রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে মার্কিন-চিন শুল্ক সংঘাত, কিংবা পশ্চিম এশিয়ায় হামাস ও ইজ়রায়েলের মধ্যে টানা লড়াই—বিগত কয়েক বছরে একাধিক সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে গোটা বিশ্ব। এই টানাপড়েনে ক্রমশ জোরাল হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা। বহু বিশ্লেষক মনে করছেন, পৃথিবীর তাবড় শক্তিধর দেশগুলি ইতিমধ্যেই এই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ(World War III in the world) যদি হয়, তবে তার ময়দান হবে সমুদ্র—এমনটাই মত সাবেক সেনাকর্তা ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের। তাঁদের মতে, বিশ্ব বাণিজ্যের মূল শিরা হয়ে দাঁড়ানো আটটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ বা ‘চোক পয়েন্ট’ হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের সংঘাতের প্রধান কেন্দ্র। এই অঞ্চলগুলি যদি কোনও একটি বা একাধিক দেশের হাতে চলে যায়, তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেখান থেকেই তৈরি হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মঞ্চ।
‘চোক পয়েন্ট’ বলতে বোঝানো হয় সমুদ্রের এমন সরু জলপথ, যেখান দিয়ে নিয়মিতভাবে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে। এটি প্রাকৃতিক হতে পারে, যেমন হরমুজ় বা মলাক্কা প্রণালী, আবার মানুষের তৈরি খালও হতে পারে, যেমন সুয়েজ় বা পানামা খাল। এ সব জায়গার কৌশলগত গুরুত্ব এতটাই বেশি যে সেগুলির নিয়ন্ত্রণ হারালে একটি দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিই নড়ে যেতে পারে।
বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ বাণিজ্য হয় সমুদ্রপথে। ফলে ‘চোক পয়েন্ট’গুলিতে জাহাজ চলাচলের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে এই সরু রাস্তাগুলিতে চলাচল যেমন কঠিন, তেমনই তা অতি বিপজ্জনক। তা সত্ত্বেও খরচ ও সময় বাঁচাতে প্রায় সব দেশ এই পথগুলি ব্যবহার করে। যেমন, পানামা খালের মাধ্যমে প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে দূরত্ব কমে যায় প্রায় ৮,৩০০ কিলোমিটার। কিন্তু খালটি বন্ধ হয়ে গেলে, জাহাজকে দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে যেতে হয় প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার। এতে খরচ এবং সময়—দুটিই বহুগুণ বেড়ে যায়।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, অর্থনৈতিক সংকট ও বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণই একাধিক সংঘর্ষের কারণ হয়ে উঠেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ভার্সাই চুক্তির ফলে জার্মানির অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়। ফলস্বরূপ, হিটলারের উত্থান ঘটে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। আজকের দিনে সমুদ্রপথ ঘিরে অনুরূপ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলেই মত বিশ্লেষকদের।
বিশেষ করে হরমুজ় প্রণালী নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চরম টানাপড়েনের নজির রয়েছে। ২০২০ সালে কাসেম সুলেমানির হত্যাকে কেন্দ্র করে সেই প্রণালীতে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়। যদিও তা সাময়িকভাবে রোধ করা গিয়েছিল, তবু সংঘাত যে কতটা তীব্র হতে পারে, তা প্রমাণিত হয়।
হরমুজ় প্রণালী দিয়ে প্রতি দিন প্রায় ৩৩০ কোটি লিটার অপরিশোধিত তেল পরিবহণ হয়। এটি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর ও ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পথের উপর স্বাভাবিকভাবেই নজর আমেরিকার। অপর দিকে, ইরানও এই পথ নিয়ে আপসহীন। এখানেই সংঘাতের সূচনা।
একই রকমভাবে মলাক্কা প্রণালী নিয়েও সংঘর্ষ সম্ভাবনা প্রবল। চিনের বাণিজ্যের একটি বড় অংশ এই পথে নির্ভরশীল। ফলে প্রণালীটির উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমে বেজিং সক্রিয়। অন্য দিকে, এটি যদি চিনের হাতে চলে যায়, তবে মার্কিন জাহাজগুলির ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ঢোকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। ফলে এই অঞ্চলেও সংঘাতের আশঙ্কা প্রবল।
পানামা খাল নিয়েও চলছে আন্তর্জাতিক টানাপড়েন। প্রথমে এটি আমেরিকার হাতে থাকলেও ১৯৯৯ সালে পানামা সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সেখানে চিনের প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত খালটি ফের দখলে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। সামরিক বিকল্পের কথাও তোলা হয়েছিল।
এছাড়াও, বাব এল-মান্দেব প্রণালী, যা লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরকে সংযুক্ত করে, সেটিও জ্বালানি পরিবহণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সুয়েজ খালের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে সংযোগ থাকায় এই চোক পয়েন্টও বিশ্বের নজরে রয়েছে।
যদিও কিছু বিশেষজ্ঞ, যেমন ইউএস নেভাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক মিলান ভিগো, মনে করেন যে, আধুনিক প্রযুক্তির যুগে খোলা সমুদ্র থেকেও আক্রমণ সম্ভব। ফলে সরু ‘চোক পয়েন্ট’-কে ঘিরে যুদ্ধ বাধবেই, এমনটা অনিবার্য নয়। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনিও স্বীকার করেন, সমুদ্রপথের উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে সংঘাত যে আরও বাড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখন প্রশ্ন একটাই—এই সংঘাত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? ইতিহাস কি আবারও নিজেকে পুনরাবৃত্তি করবে? উত্তর সময় দেবে। তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন যদি ছড়ায়, তার সূত্র যে সমুদ্রের বুকে, তাতে সন্দেহ কম।
আরও আপডেট পেতে চোখ রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটে।
নিয়মিত বাংলা সংবাদের আপডেট পেতে আমাদের ফলো করুন